হে সূর্য। শীতের সূর্য।
হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়
আমরা থাকি,
যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ
ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে।
হে সূর্য, তুমি তো জানো,
আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!
সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে,
এক টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে,
কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই।
সকালের এক টুকরো রোদ্দুর-
এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামি।
ঘর ছেড়ে আমরা এদিক-ওদিকে যাই—
এক টুকরো রোদ্দুরের তৃষ্ণায়।
হে সূর্য!
তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও,
আর উত্তাপ দিও
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
হে সূর্য।
তুমি আমাদের উত্তাপ দিও—
শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড,
তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে
একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকেই
এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হব।
তারপর সেই উত্তাপে যখন পুড়বে আমাদের জড়তা,
তখন হয়তো গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারব
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী
প্রার্থী — প্রার্থনাকারী, আবেদনকারী।
হিমশীতল — তুষারের মতো ঠান্ডা।
স্যাঁতসেঁতে — ভেজা ভাবযুক্ত।
অগ্নিপিণ্ড — আগুনের গোলা।
জড়তা — জড়ের ভাব,আড়ষ্টতা।
অকৃপণ — কৃপণ নয় এমন । উদার।
এ কবিতা পাঠ করে শিক্ষার্থীদের মনে অবহেলিত, বঞ্চিত ও দীন-দরিদ্র মানুষের প্রতি মমতা সৃষ্টি হবে। অন্নহীন, বস্ত্রহীন ও আশ্রয়হীন মানুষের দুর্দশায় তারা ব্যথিত হবে।
‘প্রার্থী' কবিতাটি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র' কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। আমাদের এই পৃথিবীতে শক্তির মূল উৎস সূর্য। সূর্য যে তাপ বিকিরণ করে তার সাহায্যেই ভূপৃষ্ঠে উদ্ভিদ, জীবজন্তু ও মানুষ জীবনধারণ করে। প্রচণ্ড শীতে সূর্যের এই উত্তাপের জন্য সারারাত অপেক্ষা করে বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন শীতার্ত মানুষ ৷ কৰিব সমাজের নিচুতলার মানুষের প্রতি গভীর মমতা থেকে সূর্যের কাছে উত্তাপ প্রার্থনা করেছেন। অবহেলিত ও বঞ্চিত শিশুর প্রতি তাঁর অসীম মমতা। কবি এই শিশুদের কল্যাণে সূর্যের অবদান থেকে প্রেরণা নিতে চান । তিনি এমন সমাজ গড়তে চান— যাতে বস্ত্রহীন শীতার্ত মানুষের জীবন থেকে সব দুঃখ চিরতরে ঘুচে যায়।
সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এই সন্তান অল্প বয়সেই শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করে তোলেন। বামপন্থি-বিপ্লবী কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। বঞ্চনাকাতর মানুষের জীবন-যন্ত্রণার চিত্র যেমন তাঁর কবিতায় অঙ্কিত হয়েছে তেমনি প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের সুর উচ্চারিত হয়েছে। তিনি সেকালের দৈনিক পত্রিকা 'স্বাধীনতার কিশোর সভা অংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। আমৃত্যু তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কবিতায় মানবমুক্তির জয়গান বলিষ্ঠভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের নাম : ‘ছাড়পত্র’,‘ঘুম নেই’, ‘পূর্বাভাস’, ‘অভিযান’, ‘হরতাল' ও ‘গীতিগুচ্ছ'। সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
ক. ‘সামাজিক বৈষম্য জাতীয় অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা' – এই মতের পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের আয়োজন - করো (দলগত কাজ)।
খ. গত সপ্তাহে কে, কী ধরনের ভাল কাজ করেছ, এর একটি তালিকা তৈরি করে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করো (একক কাজ)।
আরও দেখুন...